মালয়েশিয়া শ্রমবাজার নিয়ে গঠিত চক্রে ঢুকে বাণিজ্য করা চার সাবেক সংসদ সদস্যের (এমপি) বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চক্রটি দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে।

দুদক সূত্র জানায়, সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি অভিযোগ অনুসন্ধান করবে। অভিযোগের বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে দুদক।


এই চক্রের চার সাবেক সংসদ সদস্য হলেন নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ ও আ হ ম মুস্তাফা কামাল। চক্রে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে, অন্যটি মেয়ে নাফিসা কামালের নামে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তাঁরা সবাই আত্মগোপনে আছেন। এর মধ্যে আ হ ম মুস্তাফা কামাল সিঙ্গাপুরে বলে জানা গেছে।


সারসংক্ষেপে বলা হয়, ফেনী–২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড নামে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন। এরপর সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠায় স্নিগ্ধা। মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট বা চক্রে যোগ দেওয়ার পর দেড় বছরে প্রায় ৮ হাজার কর্মী গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির নামে।


সারসংক্ষেপের তথ্য বলছে, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল নামে রিক্রুটিং এজেন্সি করেন। মালয়েশিয়ায় এককভাবে শ্রমিক পাঠানোর শীর্ষে রয়েছে ফাইভ এম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মতো কর্মী পাঠালেও মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে ৮ হাজার ৫৯২ কর্মী।


ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর দিক থেকে পঞ্চম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। মালয়েশিয়া শ্রমবাজার চালুর আগে তাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। বিদেশে পাঠিয়েছিল মাত্র ২৩৮ কর্মী। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে তারা শীর্ষ তালিকায় চলে যায়। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ কর্মী। চক্র গঠনের সময় বেনজীর ছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি।


সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন মোট ৯ হাজার ৮৬১ জন। চক্র গঠনের সময় তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।


দুদক বলছে, তিন সংসদ সদস্য ও একজন সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এ খাতের নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশে এমন চক্র-ব্যবস্থা নেই। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো বসে বসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে অন্তত দেড় লাখ টাকা ‘চক্র ফি’ পাচ্ছে। অন্যান্য এজেন্সির মধ্যে অন্যতম হলো ঐশী ইন্টারন্যাশনাল, নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড, পিআর ওভারসিজ, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ, বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড এবং অনন্য অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সি।


দুদকের সারসংক্ষেপে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে চার লাখের মতো কর্মী পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফিয়ের চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চক্র ফি নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।


তবে মালয়েশিয়া শ্রমবাজার চক্রের হোতা হিসেবে পরিচিত রুহুল আমিন ওরফে স্বপনের নাম আলাদা করে দুদকের সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়নি

Post a Comment

Previous Post Next Post
You have to wait 15 seconds.